বেহাল জনধন যোজনা

প্রতীকী চিত্র

কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তথ্যেই প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনার বেহাল চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনধন যোজনার মাধ্যমে গরিব মানুষকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে, তাঁদের নাকি বিপুল আর্থিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা গিয়েছে বলে বিজেপি টানা প্রচার চালিয়ে গিয়েছে। তবে তার বাস্তবতা যে কতটা অসার, তা অর্থমন্ত্রকই প্রকাশ করে দিয়েছে।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনা নিয়ে অর্থমন্ত্রকের পেশ করা তথ্যে গরিব মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়নের বেহাল চিত্র ধরা পড়েছে। তথ্যে দেখা গিয়েছে, জনধন যোজনায় মোট যতগুলি অ্যাকাউন্ট হয়েছে, তার ৩০ শতাংশ অ্যাকাউন্ট কোনও লেনদেন না থাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ১০ শতাংশ অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা নেই। সব মিলিয়ে জনধনের ৪০ শতাংশ অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয়। সরকারি জনধন প্রকল্পের টাকা সরাসরি এই অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে বলে প্রচার হলেও, সেই প্রকল্পের টাকা বিশেষ কিছু জমা পড়েনি। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গরিব মানুষের জনধন অ্যাকাউন্টে সরকারের উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা, আজ এক বড় তামাশায় পরিণত হয়েছে।

ক্ষমতায় এসে গরিব ক্ষমতায়নের নামে মোদী ‘প্রধানমন্ত্রী জনধন ‘যোজনা চালু করেন। ২০১৪-র ২৮ আগস্ট এই জনধন যোজনা প্রকল্প ঘোষণা করে মোদী বলেছিলেন, দরিদ্র মানুষের আর্থিক ক্ষমতায়নের জন্য এক অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের নানা প্রকল্পে উন্নয়নের আর্থিক সুফল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের ঘরে পৌঁছে যাবে। এটা ‘গেম চেঞ্জার’ উদ্যোগ বলে মোদী দাবি করেন।


মোদীর সেই ‘গেম চেঞ্জার’ প্রকল্পে দরিদ্র মানুষের অ্যাকাউন্টের কতটা আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল অর্থমন্ত্রীর কাছে। প্রশ্ন ছিল, গত এক দশকে জনধনে কত অ্যাকাউন্ট হয়েছে? তার কতগুলি চালু রয়েছে? মন্ত্রী জানিয়েছেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৬ কোটি ৯৮ লক্ষ জনধন অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বা ১৫ কোটি ৭ লক্ষ নিষ্ক্রিয়। এদিকে কোনও লেনদেন না চলায় এক টাকাও নেই এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বা ৫ কোটি ২১ লক্ষ। জনধনের এই ৪০ শতাংশ অ্যাকাউন্টেকে বাদ দিলে যে ৩৫ কোটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার ৮৫ শতাংশের আধার সংযোগ রয়েছে। ফলে সেই আধার সংযোগে সরকারি কিছু প্রকল্পে আর্থিক সুবিধা জনধন যোজনার অ্যাকাউন্টে মেলে। বর্তমানে জনধন অ্যাকাউন্টে গড় জমা অর্থের পরিমাণ হলো ৪ হাজার ৫৪২ টাকা। ফলে জনধন প্রকল্পে দারিদ্র্য দূর হয়ে সঞ্চয় খুব একটা বাড়েনি, তা বোঝা যায়।

মন্ত্রী জানিয়েছেন, দু’টি সমাজকল্যাণ প্রকল্প যেমন প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা এবং প্রধানমন্ত্রী জীবন বিমা যোজনায় যথাক্রমে জনধন যোজনার ৬ কোটি এবং ১৬ কোটি অ্যাকাউন্টে দুই বিমার টাকা দেওয়া হয়। ফলে দেখা গিয়েছে, জনধন অ্যাকাউন্টে সকলের কাছে মোদীর উন্নয়নের সব সুফল পৌঁছয় না। প্রচারে জনধন প্রকল্প দেশের দারিদ্র্য দূর করার ‘গেম চেঞ্জার’ বলে দাবি করা হলেও তা যে ভাঁওতা, মন্ত্রীর জবাবেই তা স্পষ্ট।

এদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পরিবার পিছু ঋণ এবং সঞ্চয়ের যে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্কটের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে এতে স্বাভাবিকভাবে একেবারে পিছিয়ে থাকা দরিদ্র মানুষ আর্থিক সঙ্কটে আরও বেহাল অবস্থায় পড়েছেন। নানা সরকারি প্রকল্পের প্রচার থাকলেও জনধন অ্যাকাউন্টে কোনও ফায়দা তাদের হয়নি। অর্থমন্ত্রী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিবারপিছু সমীক্ষা রিপোর্ট উল্লেখ করে জানিয়েছেন, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক দশকে পরিবারপিছু আয়ের পরিমাণ কমেই চলেছে। এতে উদ্বৃত্ত অর্থের সঞ্চয়ের হার কমছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সমীক্ষা সূত্রে মন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে পরিবারপিছু সঞ্চয়ের হার ২০১৪-১৫ সালে ছিল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭.১ শতাংশ। কোভিড অতিমারীর পর কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় বহু মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন। এতে পরিবারপিছু আয় কমতে থাকে। ফলে পরিবারের সঞ্চয়ের হারও কমে যেতে থাকে। ২০২১-২২ সালে সঞ্চয়ের হার ছিল জিডিপি-র ৭.৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালে তা কমে হয় ৫.২ শতাংশ।

একদিকে আয় কমে গিয়ে সঞ্চয় কমছে, অন্যদিকে একই সময়ে পরিবারের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। ২০১৪১-১৫ সালে পরিবারপিছু ঋণের বোঝা ছিল জিডিপি-র ৩ শতাংশ। তা ২০২৩-২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। এক দশকে পরিবারের আয় কমে গিয়ে ঋণের বোঝা দ্বিগুণ হয়েছে। সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় দিন আনি দিন খাই করিব মানুষের সঙ্কট আরও বেড়েছে। ফলে মোদীর এক দশক আগের ‘গেম চেঞ্জার’ হাতিয়ারে গরিব কমার কোনও চেঞ্জ আসেনি। দারিদ্র্য এতে আরও প্রকট হয়েছে।