আফগানিস্থানের সঙ্গে তফাৎ মুছে দিচ্ছে জুলাই আন্দোলনোত্তর বাংলাদেশ

ফাইল চিত্র

বরুণ দাস

‘জুলাই আন্দোলন’-এর পর প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেল বাংলাদেশ। সেখানের  অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং তাঁর অর্বাচীন উপদেষ্টারা প্রতিদিন যেসব অকল্পনীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তাতে কলের পুতুলের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান তথা শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস—তাতে আর যাই হোক না কেন—তাঁর উচ্চশিক্ষাগত যোগ্যতা এবং নোবেল খেতাবের কোনও মূল্য থাকছে না! একথা শিক্ষা-দীক্ষা নির্বিশেষে তামাম বিশ্বের মানুষ বুঝলেও তিনি বুঝতে অপারগ।

তাঁর এই ‘অপারগতা’র নেপথ্যে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে তা কিন্তু মোটেই পরিষ্কার নয়। এটা তো সবার কাছেই কমবেশি পরিষ্কার যে, তিনি তাঁর উপদেষ্টাদের মতো অর্বাচীন নন। তিনি আওয়ামি লিগ ও তাঁর সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ওয়াজেদের ঘোর বিরোধী হলেও কট্টর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ হিসেবে সেভাবে পরিচিত ছিলেন না। ছিলেন না মৌলবাদি মনের মানুষও। বাংলাদেশে মাইক্রো ফিনান্স-এর জনক ড. মুহম্মদ ইউনূস প্রথমে নিজের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। পরে বিদেশে।


উল্লেখ্য, কর ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে বিদায়ী হাসিনা সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক আইনি পদক্ষেপ নেওয়ায় তিনি সবিশেষ ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং হয়তো মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার ছকও কষছিলেন। কিন্তু ওই ছক বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না— আইন মোতাবেক পথে পা বাড়ানো ব্যতীত। তাঁর এই ক্ষোভকে হাতিয়ার করে আমেরিকা-পাকিস্থান-চিন এই ত্রিমূর্তি মাঠে নেমে পড়ে এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং একইসঙ্গে ভারতকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে শিখন্ডি হিসেবে কাজে লাগায় ড. মুহম্মদ ইউনূসকে।

পাকিস্তান আর চিন বরাবরই ভারতকে কোণঠাসা করতে বদ্ধপরিকর। তার কারণও আমাদের সবারই কমবেশি জানা। ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি পাকিস্তান মেনে নিতে পারেনি। যুদ্ধ করেও ভারতের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছে। এবং পূর্ব পাকিস্থানের ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধেও তাঁরা হেরেছে ‘শত্রুরাষ্ট্র’ ভারতের কাছে। এছাড়া সীমান্তের দীর্ঘস্থায়ী ছায়া যুদ্ধেও তারা বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। তাই চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতকে সবক শেখানোর চেষ্টা আর কী!

ভারত বরাবর শান্তির পথে চলার দৃঢ় অঙ্গীকার করেও রেহাই পায়নি রহস্যময় লাল চিনের হাত থেকে। ১৯৬২-র চিন-ভারত যুদ্ধই তাঁর প্রকৃষট প্রমাণ। পঞ্চশীলা-নীতির পঞ্চস্থ প্রাপ্তির জন্য দায়ী কারা- তা নিয়ে হয়তো ভারতীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে বিভ্রান্তি বা সংশয় আছে; কিন্তু ভারতের আপামর জনগণ এতোদিনে প্রকৃত সত্য জেনে গেছেন। কারণ প্রতিবেশি চিনকে সবক শেখানোর মতো ‘যুদ্ধং দেহি’ মানসিকতা কিংবা সামরিক সক্ষমতা তৎকালীন দুর্বল চিত্তের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর ছিল না একথা বলাই বাহুল্য।

বাকি থাকে আমেরিকা৷ বিদায়ী বাইডেন সরকারের স্বার্থ কী ছিল? আমেরিকা বরাবরই তার নিজের আগ্রাসী বিদেশনীতি প্রণয়নে অভ্যস্ত। এ নিয়ে সে বিশ্বের কারও পরোয়া করেনা। মুখে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধি কথা বললেও সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘর পাকিস্তানের দিকেই তাঁর সহানুভূতির পাল্লা ভারী থাকে। অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে তাকে সতেজ ও সবল রাখে যাতে ভারতকে তটস্থ রাখা যায়। এই দ্বিচারিতার মূলে অবশ্য ভারতের বিশাল মাপের বাজারের ওপর দখল রাখা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দেশেও ঢালাও যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি।

এছাড়া বাংলাদেশের জন্মের ব্যাপারেও আমেরিকার প্রবল বিরোধিতা ছিল। কারণ পাকিস্তানের স্বার্থে আঘাত আসুক তা সে আদৌ চায়নি। এবং একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছিল বলে ভারতকে হুমকি স্বরূপ নৌবহর পাঠানোর কথা তো সবাই জানেন। স্বার্থপর আর ধুরন্ধর দেশ আমেরিকার নিগূঢ় পাক-প্রেম তো বরাবরই ওপেন সিক্রেট- সবাই জানেন। নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। যদিও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সামরিক শক্তি এখন পর্যন্ত কারও নেই।

আগে তালিবানদের দেশ হিসেবে আফগানিস্তান বোঝাত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি দেশ—জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ। যে ছাত্র-জনতার ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম—সেই ‘ছাত্র- জনতা’র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আবার তালিবানি রাষ্ট্রে রূপান্তর গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। শুধু অসাম্প্রদায়িকতা মুছে গিয়ে সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত হয়েছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মৌলবাদ ও গোঁড়ামির পাল্লাটা ভারী হয়েছে। একাত্তরের সঙ্গে ২০২৪-এর মৌলিক পার্থক্যটা বোধহয় ঠিক এখানেই।

আন্তর্জাতিক নারীদিবসের প্রাক্কালে মহিলাদের বাড়ি থেকে বেরোনোর নিষেধাজ্ঞা দিল সেদেশের কট্টর শরিয়তপন্থি মৌলবাদিরা। আফগানিস্তানের পথে হেঁটে এই প্রকাশ্য তালিবানি ফতোয়া তাদের। নারীদের প্রতি কেন এই ফতোয়া? তাদের যুক্তি, রমজান মাস চলছে। রোজা চলাকালীন সময়ে মহিলারা বাড়ির বাইরে বেরোলে তাঁদের দেখলে পুরুষদের চোখের গুনাহ হবে। তাই এসময় মহিলারা যেন কোনও ভাবেই বাইরে বের না হয়। তাদের এই ফতোয়া মানা না হলে কী শাস্তি দেওয়া হবে তা অবশ্য খোসলা করেনি তারা।

ইসলামিক মৌলবাদিদের ‘স্পষ্ট বক্তব্য, মহিলারা বাড়ি থেকে বের হলে তাদের যদি রোজা রাখা কোনও পুরুষ দেখে ফেলেন- তাহলে রোজাই নাকি ভঙ্গ হয়ে যাবে। তা কী করে হয়। মুহম্মদ ইউনুসের ও তাঁর উপদেষ্টাদের নেতৃত্বে ইসলামিকরণের পথে পা বাড়ানো এসব কট্টরপন্থীরা তাই ফতোয়া জারি করেছেন। তাই চরম নারী-বিরোধি এই ফতোয়াকে না মেনে উপায়ই-বা কী। যাঁরা মানবেন না— তাঁদের হয়তো কঠোর ও কঠিনতম শাস্তির মুখোমুখি পড়তে হবে। কে আর তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চান।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার ‘জুলাই আন্দোলন’-এর চাপে গত বছেরর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পরই সেদেশের কট্টর শরিয়তপন্থী মৌলবাদিরা নানাবিধ কড়া নিষেধাজ্ঞা তথা মহিলাদের ওপর দমন-পীড়নের সহজ পথ বেছে নিয়েছে। গোটা দেশ জুড়ে তাদের কট্টর মৌলবাদি কর্মকান্ড হার মানাচ্ছে আফগানিস্তানের সাবেকি কট্টর তালিবানদেরও। চোখে শরিয়তি কাজল লাগিয়ে বাংলার তালিবানরা নিজেদেরকে আরও এক ধাপ উঁচুতে নিয়ে যেতে ভীষণভাবেই আগ্রহী।

একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, নারীর মুখ দেখলে রোজা ‘বিফলে যাবে। ‘গুনাহ হবে।’ সামনে নয়, পিছনের দিকে হাঁটতেই তারা উৎসাহ বোধ করেন। ধর্মান্ধতার কড়া বিষ কতদূর গ্রাস করলে এমন অন্ধবিশ্বাস আর মানসিকতার জন্ম দেয় তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু ওইসব ধর্মান্ধরা তাদের লক্ষ্যে স্থির। মধ্যযুগে ফিরে যেতে চায় তারা। উজ্জ্বল আলো নয়, ঘন অন্ধকারই তাদের একেমাত্র কাম্য। এই অন্ধকারকে অবলম্বন করেই তারা বেঁচে-বর্তে থাকতে চায়। আলোতে তারা অস্বস্তি বধ করেন।

মুহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা অবাধেই নিত্যদিন তালিবানি কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ড. ইউনূসের পারিষদবর্গ কোথাও সরাসরি, কোথাও বা পরোক্ষে মদত দিয়ে চলেছে এই তালিবানি কর্মকান্ডে। আর এভাবেই দেশটি দ্রুত নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তোলা ঐতিহ্য ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। এরফলে গোটা বিশ্বের কাছেই মুখ পুড়ে যাচ্ছে ৫৩ বছরের বাঙালি অধ্যুষিত একটি সুন্দর দেশের। যারা স্বাধীনতার পর নিজেদের বলে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সফলতা অর্জন করেছিল।

বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল- আওয়ামি লিগের পরই যাদের স্থান— সেই বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগ, দেশে নৈরাজ্য চলছে। নির্যাতনের শিকার নারীরা৷ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন বিএনপি-সচিব ফখরুল। তাঁর কথায়, উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের প্রবণতা খুবই বিপজ্জনক।

এই সব ঘটনা ঘটিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি স্পষ্টতই বলেন, ‘নারীদের সম্মান এবং নারীদের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’ অথচ একসময় তাদেরই নির্বাচনি দোসর ছিল জামায়েত ইসলামের মতো কট্টর মৌলবাদি দল। বিষবৃক্ষ পোঁতার দায় তাঁরাই কী এড়াতে পারেন? আসলে ভোট- রাজনীতির স্বার্থে ঝান্ডা নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা যেসব কুকর্ম করে থাকেন- তার দায়ভার কেন নিরপরাধ দেশবাসী বহন করবেন? কুফল তাদের একার কাঁধেই নিতে হবে।

আওয়ামি লিগ সরকারই যে কোটা প্রথা তুলে দেওয়ার জন্য মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হয়, সেখানে আন্দোলনের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু দেশবাসীর দুর্ভাগ্য এই যে, কোটা বা বৈষম্য-বিরোধি আন্দোলনে কট্টর মৌলবাদি জামায়েত ইসলাম প্রভাবিত তথাকথিত ‘ছাত্র-জনতা’র সঙ্গে তারাও (বিএনপি) তো কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন, পায়ে পা মিলিয়েছিলেন- নাকি? যা শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত হয়। এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে গেলে চলে? দেশবাসী যে ভোলেননি জনাব ফখরুল ভাই।

এতদিন যারা মুক্তমনে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেছেন, তারা এখন ঘরের মধ্যে বন্দি না-হয় তো প্রয়োজনে হিজাব-বোরখা পরে বাড়ির বাইরে বেরুবেন। আগামীদিনে স্কুল-কলেজে যেতেও বাধা আসবে। পুরুষদের যৌনচাহিদা মেটানো আর সন্তান উৎপাদন ছাড়া নারীদের আর কোনও কাজই থাকবে না। শরিয়তি বিধান না মানলে কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হবে সেদেশের নারীদের একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ধর্মান্ধতার ক্ষেত্রে ‘তুই বড়ো না আমি বড়ো’— এই লড়াই-ই চলবে ইরান-আফগানিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে!

সবদেশের ধর্মীয় মৌলবাদিদের কাছে প্রথম সফট টার্গেট হলো নারীরা এবং দ্বিতীয় টার্গেট অবশ্যই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এই পরিচিত ছবির তেমন কোনও ওলট-পালট দেখা যায় না। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-মায়নমার-শ্রীলঙ্কা— এই উপমহাদেশের দেশগুলির দিকে একবার তাকান। সর্বত্রই প্রায় একই চিত্র। যাকে বলে মুদ্রার এ-পীঠ আর ও-পীঠ। পার্থক্য উনিশ-বিশ মাত্র। ড. মুহম্মদ ইউনূস, আপনি নিজের উচ্চশিক্ষা আর নোবেল পুরস্কারকে কলঙ্কিত করেছেন। মনুষ্যত্ব আর মানবিকতার অবমাননা করেছেন।

আপনি বাংলা ও বাঙালির অন্তহীন অমর্যাদা করেছেন। একটা উন্নয়নশীল দেশকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাস কী আপনাকে কোনওদিন ক্ষমা করবে? কী বলেন আপনি? স্রেফ হাসিনা-বিরোধিতাকে (ব্যক্তি-বিদ্বেষ বা ক্রোধ) কেন একটা সমুদায় জাতির ওপর চাপিয়ে দিলেন? আপনি তো ক্ষমারও অযোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। নিরপরাধ দেশবাসী আপনি ও আপনার অর্বাচীন উপদেষ্টাদের কৃতকর্মের জন্য গোটা বিশ্বে আজ অপরাধী হিসেবে গণ্য হচ্ছেন!