আব্বাস কিয়েরোস্টামি: জীবন পথের পথিক

সুব্রত রায়

আব্বাস কিয়েরোস্টামির ছবি নিয়ে অনেক কথা বলা ও লেখা হয়েছে বিগত দু’দশক ধরে। তবু অনেক কথা বলাও হয়নি। তাঁর ছবিগুলি নতুন করে দেখতে বসলে সে উপলব্ধি হয়। তাঁর ছায়া বিশ্ব চলচ্চিত্রে এতটাই দীর্ঘ যে তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তবে সাম্প্রতিক প্রাচ্য ছবির ক্ষেত্রে তাঁর ছবির ঋণ স্বীকার করেছেন সকলেই।

তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে কেবল নিওরিয়ালিজম নয়, কিয়েরোস্টামির অনেক ছবিতে নিউ ওয়েভের প্রভাবও দেখতে পাওয়া যায়। ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবির অন্তিম দৃশ্যের কথা ভাবা যেতে পারে শেষ দৃশ্যে বোঝা যায় না চরিত্রটি সত্যিই আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল কিনা, নাকি তা আসলে একটি ফিল্মের শুটিংয়ের অংশ। কিয়েরোস্টামির ছবির আখ্যান কোনও সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয় না। তাঁর ছবির ইমেজে আপাতভাবে কোনও দুর্বোধ্যতা থাকে না। কিন্তু যদি আখ্যানের কথা ভাবি, তাহলে দেখব তার কোনও সুনির্দিষ্ট পরিণতি নেই— নিউ ওয়েভ ছবির ধারায়, যা স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করা যায় সেরকমই। অর্থাৎ সিদ্ধান্তটা নেবেন দর্শক। আখ্যান একটা ‘অনির্দিষ্ট’ সমাপ্তি ঘটাবে। বাকি কাজ দর্শকের জন্য সযত্নে তোলা থাকবে। কিয়েরোস্টামির ‘হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম’ ছবিটি আট বছরের ছেলে আহমেদের জার্নি। সেখানে শহর নেই, আছে বন্ধুর খোঁজে অচেনা গ্রামে যাত্রা। বাড়ি, চেনা গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, আহমেদের ভিন গাঁয়ে যাত্রা। ঘাসে ঢাকা টিলা পার হয়ে সর্পিল পথ, একাকী দাঁড়িয়ে থাকে একটি গাছ। সেটা পেরিয়ে সে পৌঁছে যায় পাশের গাঁয়ে। গ্রামের পাথুরে সরু পথ, ছোটখাটো কাঠের বাড়ি, অচেনা সব মানুষের সঙ্গে দেখা হয় তার। শৈশবের কল্পনার পক্ষীরাজে চড়ে মানস ভ্রমণের জগৎ, তার ব্যাটনটা হস্তান্তর করে বাস্তবের হাতে। বালক আহমেদের সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে আমরা বুঝি বাধানিষেধের গণ্ডিটা পেরোতে পারলেই পৃথিবীটা কত সুন্দর।


ইরানের নব্য চলচ্চিত্রের ভাষা যেভাবে নিওরিয়ালিজমের বাস্তববাদকে ফুলে ফুলে কুসুমিত করে তুলেছে, তাদের ছবিতে তা দারিয়স মেহেরজুই, মজিদ মাজিদি, সামিরা মাখবলবাফ, আব্বাস কিয়েরোস্টামি, মহসিন মাখবলবাফ আর জাফর পানাহির অনবদ্য ছবিগুলি দেখলে বোঝা যায়। কিয়েরোস্টামির জার্নি ছবিগুলিতে অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে নিওরিয়ালিজমের আধুনিক বয়ানের সঙ্গে।

ইরানের আধুনিক চিন্তাবিদদের বড় সমস্যা হল সে নিঃসঙ্গ। তার নিঃসঙ্গতার আর একটি বড় কারণ তার বিচ্ছিন্নতা। সে জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন। তার অর্থ এই নয় যে, জনতার প্রতিরোধ, প্রতিবাদে সে পাশে থাকে না, বরং ঘটনা ঠিক তার উল্টো। তার বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হলো সে আধুনিকতার যে স্তরে চিন্তা করে তার দেশের জনতা সেই আধুনিকতার স্তরে বাস করে না। সে দেশে মুক্তি সংগ্রাম বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সে বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত।

আসলে ‘টেস্ট অফ চেরি’ একটি বাহুস্তরীয় আখ্যান। যেমন, কিয়েরোস্টামির আঁকা ছবি, তার ফটোগ্রাফ বা তার লেখা কবিতায় আমরা একটি একাকী গাছকে দেখি। আবার জার্নি প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আরও অন্তত তিনটি ছবি নিয়ে এই পরিপ্রেক্ষিতের কথা বলা যেতে পারে ‘অ্যান্ড লাইফ গোস অন’, ‘উইন্ড উইল ক্যারি আস’, এবং, ‘সার্টিফায়েড কপি’। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে ‘টেন’ এই ছবিগুলির বেশিরভাগ অংশ শুট করা হয়েছে যাত্রাপথে গাড়ির মধ্য থেকে। ‘অ্যান্ড লাইফ গোস অন’ ছবিতে গাড়ি চলেছে তেহরান থেকে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত খোকর নামের একটি গ্রামের উদেশে। যে গ্রামে বাস করে ‘হোয়ার ইস মাই ফ্রেন্ড’ ছবির দুই শিশু অভিনেতা। কোথায়, কেমন আছে তারা এই বিপর্যয়ের দিনে। কিয়েরোস্টামির অন্য ছবিগুলির মতো এই ছবির নিসর্গ এত সুন্দর নয়।

অবধারিতভাবে এসে পড়বে তাঁর ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিটির কথা। এক ভদ্রলোক আত্মহত্যা করতে চান কিন্তু ধর্মে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। ইসলাম ধর্ম নিজেকে জীবনের ধর্ম বলে মনে করে। কেউ আত্মহত্যা করলে কোনও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ তার গোরে মাটি দেবে না। এই আত্মহত্যাকামী মানুষটির ইচ্ছে আত্মহত্যার পর অন্তত কেউ একজন তার গোরে একমুঠো মাটি দিক। তিনি গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়েন সেরকম এক মানুষের সন্ধানে। যাত্রাপথে দেখা হলো একদল কাজের খোঁজ অপেক্ষারত শ্রমিকদের সঙ্গে। নিতান্তই গরিব মানুষ সব। ভদ্রলোক তাঁদের তাঁর পরিকল্পনার কথা বললেন। বললেন, প্রচুর টাকা তিনি দেবেন যারা তাঁর গোরে মাটি দেবে তাঁর আত্মহত্যার পর। না, কেউ রাজি নয় একাজ করতে।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাহ্যিক আধুনিকতাকে জানতে জার্নি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় আমাদের চলচ্চিত্রে। জটিল বহুস্তরীয় বাস্তবকে চলচ্চিত্রে ধরতে ন্যারেটিভ টোপ হিসাবে যে কতটা কার্যকরী তা বোধহয় আমাদের শিখিয়েছে নিওরিয়ালিজম| ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘উমবেরতো ডি লা স্ত্রাদা’ এর সফল উদাহরণ। আর ভারতীয় চলচ্চিত্রের আধুনিকতায় ‘বাইসাইকেল থিভস’-এর অবদান তো ভোলার নয়।