ভারতে অভ্যন্তরীণ জাহাজ মেরামতের বিশ্বমানের পরিকাঠামো গড়ার অদম্য প্রয়াস

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

শান্তনু ঠাকুর

ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথ আজ এক ঐতিহাসিক রূপান্তরের পথে, যে রূপান্তর দেশের পরিবহন, বাণিজ্য ও লজিস্টিক পরিসরের মানচিত্রই বদলে দিতে চলেছে। ‘মেরিটাইম অমৃতকাল ভিশন ২০৪৭’-এর অন্তর্গত সরকারের লক্ষ্য এখন স্পষ্ট নদীভিত্তিক নৌপরিবহন ব্যবস্থায় আত্মনির্ভরতা ও আধুনিকতার যুগ আনা।

সম্প্রতি গঙ্গার তীরে পাটনা ও বারাণসীতে জাহাজ মেরামত কেন্দ্র (শিপ রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি) চালুর ঘোষণা, এবং ব্রহ্মপুত্র (জাতীয় জলপথ -২) ও বরাক নদী (জাতীয় জলপথ-১৬)-এর জন্য গুয়াহাটির পাণ্ডুতে আসন্ন জাহাজ মেরামত কেন্দ্র- এই উদ্যোগগুলি কেবল পরিকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং ভারতের অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচলে আত্মনির্ভরতার এক বিরাট পদক্ষেপ।


বন্দরের, নৌপরিবহন ও জলপথ মন্ত্রকের অধীনস্থ ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া এই রূপান্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাতীয় জলপথ জুড়ে টেকসই সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে তারা এক নতুন যুগের সূচনা করছে।

পাটনা ও বারাণসীর জাহাজ মেরামত কেন্দ্র চালু হলে গঙ্গার অববাহিকায় চলাচলকারী মালবাহী জাহাজ থেকে যাত্রীবাহী ফেরি সব ধরনের জলযানই আধুনিক মেরামত পরিষেবা পাবে। এতদিন যেসব জাহাজকে দূরবর্তী উপকূলীয় ডক পর্যন্ত যেতে হত, এখন সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ হবে নদীতীরেই। এতে সময় ও ব্যয়ের সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও নদীপথ ঘিরে শিল্পোন্নয়নের সম্ভাবনা।

পাণ্ডুর জাহাজ মেরামত কেন্দ্রটি উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য এক প্রাণশক্তি হয়ে উঠবে। চালু হলে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদীপথে চলাচলকারী সরকারি ও বেসরকারি উভয় জলযানের রক্ষণাবেক্ষণ এখান থেকেই সম্ভব হবে। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও দৃঢ় হবে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ ও ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির বাস্তব রূপ ঘটবে নিরবচ্ছিন্ন লজিস্টিক সহায়তার মাধ্যমে।

এই তিন কেন্দ্র– পাটনা, বারাণসী ও পাণ্ডু – একত্রে বিকেন্দ্রীকৃত সামুদ্রিক বৃদ্ধির এক নতুন মডেল তৈরি করছে। আধুনিক শুষ্ক ডক, স্লিপওয়ে, ওয়ার্কশপ, বিশেষ যন্ত্রপাতি ও স্থানীয়ভাবে চলমান মোবাইল মেরামত ইউনিটসহ গড়ে উঠছে পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো। সমুদ্রতীর থেকে অভ্যন্তরে এই রূপান্তরই প্রমাণ করছে নদীগুলি আজ কেবল পরিবহন পথ নয়, বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন ইঞ্জিন।

এর আগে জলপথ কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই বারাণসী, সাহেবগঞ্জ ও হলদিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের বহুমাধ্যম টার্মিনাল গড়ে তুলেছে। লক্ষ্য একটাই স্বনির্ভর নৌপরিবহন ব্যবস্থা, যেখানে জাহাজ নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত সবই দেশের মাটিতেই সম্ভব হবে, বিদেশি নির্ভরতা ছাড়াই।

এই কেন্দ্রগুলি শুধু মেরামতের জায়গা নয়, বরং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নতুন জাহাজ নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক শিল্পের জাল গড়ে তুলছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এম-এস-এম-ই) সংস্থাগুলি এতে যুক্ত হয়ে ইস্পাত নির্মাণ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ও লজিস্টিক পরিষেবায় নতুন দিগন্ত খুলছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতেও এই উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে।

পাটনা ও বারাণসীর কেন্দ্রগুলি বিশেষভাবে পরিকল্পিত হয়েছে ‘জল মাৰ্গ বিকাশ প্রকল্প’-এর অন্তর্গত হলদিয়া বারাণসী করিডরকে মাথায় রেখে। এই করিডর ইতিমধ্যেই কার্গো পরিবহনে সাফল্যের নজির গড়েছে। নতুন কেন্দ্রগুলি চালু হলে জলযানের রক্ষণাবেক্ষণ আরও দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য হবে, কমবে কাজ বন্ধ থাকার সময়, আর বাড়বে বিনিয়োগ-আকর্ষণ পরিবেশের দিক থেকেও এই প্রকল্পগুলি উদাহরণযোগ্য। প্রতিটি কেন্দ্রেই থাকবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও জল পুনঃচক্রণ ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘নীল অর্থনীতি’ (ব্লু ইকোনমি) ভাবনা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের সমন্বয়— এখানেই বাস্তব রূপ পাচ্ছে।

‘মেরিটাইম অমৃতকাল ভিশন ২০৪৭’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারত এখন লক্ষ্য স্থির করেছে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ সামুদ্রিক শক্তির মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার। জাহাজ নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণ, অর্থায়ন, মালিকানা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ পুরো সামুদ্রিক মূল্য শৃঙ্খলে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী করাই এই ভিশনের উদ্দেশ্য। পাটনা, বারাণসী ও পাণ্ডুর এই কেন্দ্রগুলি তাই কেবল আলাদা প্রকল্প নয় – ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের প্রযুক্তিগত ও শিল্পগত মেরুদণ্ড গড়ে তোলার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

‘ভারত মেরিটাইম সপ্তাহ ২০২৫’ (২৭ থেকে ৩১ অক্টোবর) সামনে রেখে দেশের নদীপথ অঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত একটাই বার্তা শোনা যাচ্ছে জলপথ আর প্রান্তিক নয়,  তারা আজ দেশের সামুদ্রিক ভবিষ্যতের কেন্দ্রে৷

জলপথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই জাহাজ মেরামত কেন্দ্রগুলি শুধু ডক বা ক্রেন নয় এগুলি আত্মবিশ্বাস, পুনরুত্থান ও নবজাগরণের প্রতীক। এগুলো বলছে সেই ভারতের গল্প, যে নিজের সামুদ্রিক ঐতিহ্যকে আবার নতুনভাবে ফিরিয়ে আনছে ভবিষ্যতের পথে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ক্ষেত্র আজ প্রবেশ করছে এক নতুন যুগে দক্ষতা ও টেকসই বৃদ্ধির যুগে। আধুনিক পরিকাঠামো, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ ও নীতিগত সহায়তায় গড়ে উঠছে শক্তিশালী রক্ষণাবেক্ষণ-মেরামত-ওভারহল ব্যবস্থা। পাটনা, পাণ্ডু ও বারাণসীর এই নতুন কেন্দ্রগুলি আত্মনির্ভর, বিশ্বমানের ও ভবিষ্যতমুখী ভারতের প্রথম দৃঢ় পদক্ষেপ, যা ২০৪৭–এর অমৃতকালের পথে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সবুজ লজিস্টিকের ভিত্তি স্থাপন করবে।

লেখক কেন্দ্রীয় বন্দর, জাহাজ চলাচল ও জলপথ প্রতিমন্ত্রী