সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কোলে বসে জীবন্ত লোকসংস্কৃতি, শিল্পকলা ও মানুষের টিকে থাকার গল্প বলল ‘সুন্দরীদম ফেস্টিভ্যাল ২০২৫’। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ ও বস্ত্র দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ২০ ও ২১ ডিসেম্বর সজনেখালিতে আয়োজিত এই উৎসব হয়ে উঠল সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও জনজীবনের এক অনন্য মিলনমেলা।
ইউনেস্কোর গ্রামীণ হস্তশিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কলকাতা সোসাইটি ফর কালচারাল হেরিটেজ এই উৎসবের আয়োজন করে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শতাধিক শিল্পী ও কারুশিল্পী অংশ নেন এই দুই দিনের অনুষ্ঠানে। ছৌ, ঝুমুর, বাউল ও ফকিরি, ভাটিয়ালি, রাইবেঁশে, গম্ভীরা ও ভাওয়াইয়ার মতো লোকশিল্পে মুখর হয়ে ওঠে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত সুন্দরবন শুধু জীব-বৈচিত্র্যের জন্য নয়, মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, নোনা জল ঢুকে পড়া, পলি জমা ও মানুষের চাপ— এই সব প্রতিকূলতার মধ্যেও এখানকার লোকাচার ও বিশ্বাস টিকে আছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের মধ্যে। উৎসবের মঞ্চে সেই বার্তাই উঠে আসে যে, সংস্কৃতি কোনও জাদুঘরের বস্তু নয়, তা বাঁচে মানুষের চর্চা ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাজ্যের বিভিন্ন জেলার হস্তশিল্প ও তাঁতশিল্পের প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে গ্রামীণ শিল্পীদের জন্য বাজারের সুযোগ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনই স্থানীয় অর্থনীতিতে সংস্কৃতির ভূমিকার দিকটিও তুলে ধরা হয়েছে। সুন্দরবনের লোকজ সংগীতনাট্য বনবিবি পালা বিশেষভাবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মানুষ, প্রকৃতি ও বিশ্বাসের সহাবস্থানের এই কাহিনী সুন্দরবনের জীবনদর্শনের প্রতীক হিসেবেই ধরা পড়ে।
আয়োজকদের মতে, এই উৎসবের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করা, শিল্পী ও কারুশিল্পীদের জীবিকা সুরক্ষিত করা এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহ্য হস্তান্তরের পথ তৈরি করা। ইউনেস্কোর ‘আর্ট ফর লাইফ’ ভাবনায় পরিচালিত এই প্রকল্পে শিল্পী ও কারিগররা শুধু সংস্কৃতির বাহক নয়, তাঁদেরকে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইউনেস্কো জানিয়েছে, ২০০৩ সালের অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত সনদ এবং ২০০৫ সালের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংক্রান্ত সনদের আলোকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ২০টি জেলা জুড়ে ৩৫টি সাংস্কৃতিক উপাদান নিয়ে চলা গ্রামীণ হস্তশিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার শিল্পী ও কারুশিল্পীর জীবিকা টিকিয়ে রাখাই এই উদ্যোগের একমাত্র লক্ষ্য।
সুন্দরবনের বুকে ‘সুন্দরীদম ফেস্টিভ্যাল’ যেন মনে করিয়ে দিল— সংস্কৃতি উত্তরাধিকার নয়, প্রতিদিনের চর্চায় লালিত এক জীবন্ত শক্তি।