আশ্রম চত্বরে প্রবেশ করে দেখলাম, তখনও প্রসাদমণ্ডপে প্রসাদ বিলি হচ্ছে। হাত ধুয়ে থালা মেজে খেতে বসে গেলাম। আশ্রমের পরিবেশটা একটু থমথমে মনে হলেও অস্বাভাবিক লাগছে না। প্রসাদ পেয়ে কক্ষে গিয়ে গরম জলে স্নান করে নিলাম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।
হঠাৎ চিল চিৎকারে কান্না। সবাই চমকে উঠে বসলাম। মহিলা কন্ঠের কান্না। পূর্ণিমা বৌদি ছুটে বেরিয়ে গেলেন। আমরা ইতস্তত করছি যাব কি যাব না। বৌদি কিছুক্ষণ বাদে এলেন খবর নিয়ে। যিনি কাঁদছেন তাঁর মা পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। দিদিমা, কন্যা, নাতি, তিন প্রজন্ম একসাথে এসেছেন কুম্ভে তীর্থ করতে। রাতের ঘটনার পর দিদিমা নিখোঁজ ছিলেন। নাতনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন খোঁজ নিতে। সেখানে ৫০টি মৃতদেহ দেখার পর নিজের দিদিমার দেহ শনাক্ত করে। তারপরেও আরও মৃতদেহ ছিল। যদিও সরকারিভাবে বলা হয়েছে মৃতের সংখ্যা ৩০।
নাতনি ফিরে এসে মাকে খবর দিতেই মা অর্থাৎ দিদিমার কন্যা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আশ্রমে আর একজন ভদ্রলোক মারা গিয়েছেন। মৃতদেহগুলো আশ্রমে আনা হয়নি। হাসপাতাল বা মর্গে থেকে সরাসরি যে যার বাড়িতে নিয়ে গেছে। আর একজন ভদ্রলোকের হাত প্রায় গুড়িয়ে গেছে। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি। শুনে সবার মন ভারাক্রান্ত হল।
ছোড়দি অর্থাৎ আমাদের কক্ষের সহবাসী দিদি সুপর্ণাদি এবং তাঁর স্বামী বিভূতিদাকে দেখলাম একটু সামলে নিয়েছেন। আগেই বলেছি আমাদের কক্ষের সহবাসী ছিলেন অসম থেকে আগত তিনটি পরিবার। এরা প্রত্যেক আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। আত্মীয়তার মূলসূত্র হল মহিলারা পরস্পর তিন বোন। বড় বোনের নাম অপর্না চৌধুরী, মেজো বোনের নাম অঞ্জনা শীল, সেজো বোনের নাম সুপর্ণা চৌধুরী। সেজো বোন কারণ আর একজন বোন আছেন, তার নাম সুদীপ্তা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে থাকেন, তিনি কুম্ভে আসেননি।
অপর্ণাদেবীরা দুই ভাই, চার বোন। জন্মসূত্রে গৌহাটির বাসিন্দা। যদিও গৌহাটির বর্তমান নাম গুয়াহাটি।
আসামের বর্তমান নাম অসম। ওঁরা এখনও গৌহাটি এবং আসাম বলেন। তাই আমি ওঁদের কথা বলার গৌহাটি ও আসাম বলব। অপর্ণাদেবীর ঠাকুরদা কর্মসূত্রে এবং কিছুটা তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঁচ করে ঢাকা থেকে গৌহাটি চলে আসেন। সেটা ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগের ঘটনা।
ঠাকুরদার আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা। অপর্ণা দেবীর স্বামীর নাম দিলীপ চৌধুরী। দিলীপবাবুর আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের রংপুর জেলায়। সেখান থেকে আসামের পুরনোদিয়ারা, তারপর গোয়ালপাড়া। দিলীপবাবু আসামে বনদপ্তরে কাজ করতেন। তারপর কর্মসূত্রে গৌহাটি, তারপর কোকড়াঝোড় স্থিতু হন। কিন্তু বর্তমানে সেখানে থাকা হয় না। তাঁদের বড়পুত্র কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে থাকেন, এজন্য তাঁরা সেখানেই থাকেন। ছোটোছেলে থাকেন ব্যাঙ্গালোরে। সত্যি, মানুষ মাত্রেই যাযাবর।
মেজো বোন অঞ্জনার স্বামীর প্রদীপ শীল, ডাকনাম বাবন। আমরা বাবনদা বলে ডাকতাম। বাবনবাবু বর্তমানে শিলচরে থাকেন। তার আগে থাকতেন কোকরাঝোড় জেলার ফকিরা গ্রামে। তিনি চাকরি করতেন আসাম সরকারের জলসম্পদ দপ্তরে। তাঁদের একটিমাত্র কন্যা তাঁরও বিবাহ হয়ে গেছে।
সেজোবোন সুপর্ণাদেবীর স্বামীর নাম বিভূতি চৌধুরী। বিভূতিবাবু আবার সম্পর্কে দিলীপবাবুর ভাই। তিনি চাকরি করতেন বঙ্গাইগাঁও ভারত পেট্রোলিয়াম রিফাইনারিতে। তাঁদের একমাত্র পুত্র কর্মসূত্রে মুম্বাই থাকে। এক কথায় সবাই প্রায় ঝাড়া হাত-পা।
আমাদের জিজ্ঞাস্য ছিল তিন বোনের মধ্যে কি খুব মিল? একসঙ্গে সব জায়গায় বেড়াতে যান? উত্তর এল – মিল তো আছেই। কিন্তু সবসময় একসঙ্গে ভ্রমণ করতে যাওয়া হয় না। তবে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে সকলের সঙ্গে দেখা হয়। তবে কুম্ভে একসঙ্গে যাওয়া হবে, এই উদ্যোগ নেন বড়বোন অপর্ণাদেবী।
হঠাৎ কুম্ভ কেন? মহাকুম্ভের ঢক্কা নিনাদ? অপর্ণাদেবী বললেন পঞ্জিকা বা অন্য কোথাও কুম্ভমেলার কথা দেখেছিলাম। তখন মনে হল – আমাদের তিন বোনের স্বামীরা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, পৌঢ়ত্বের দ্বারে এসে গেছেন প্রায় সবাই। এই বয়সে একটু তীর্থ করে নিলে ভালোই হবে। তখন অপর্ণাদেবী সমস্ত ভাই-বোনদের কুম্ভ যাত্রার প্রস্তাব দেন। অপর্ণা দেবী বলেছিলেন, আমাদের বয়স হয়েছে, একা একা যাবনা গেলে একসঙ্গে যাব। প্রথমে এই তিন বোন এবং তাঁদের স্বামীরা রাজি হন।
বড়দাদা প্রথমে রাজি না হলেও পরে উনি শেষ দিকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও কুম্ভে আসবেন। তখন তৎকাল টিকিট কেটে ভারত সেবাশ্রম সংঘে ব্যবস্থা করেন। উনি অন্য একটি কক্ষে উঠেছেন, স্ত্রী ও দুই পুত্র-কন্যার সমেত। ওঁর কথা আগে একদিন বলেছি, যেদিন আমাদের ঘরে মহামতি আকবর নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
দাদার থেকে অপর্ণা প্রায় পাঁচ বছর ছোটো। তাঁদের বেড়ে ওঠা আসামের গৌহাটিতে। অপর্ণাদেবীরা থাকতেন গৌহাটির পানবাজার এলাকাতে। সেখানে একটি হরিসভা ছিল। সেই হরিসভাতে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মেয়েদের পড়ানো হত। সেখানে সমস্ত পূজা হত – দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, অন্নপূর্ণা পূজা। গ্রীষ্মের ছুটির সময় ভারত সেবাশ্রম সংঘ থেকে চারণদল আসত। সেই চারণদল গ্রীষ্মাবকাশের একমাস এই হরিসভাতে থাকতেন। নানা পূজাপাঠ, ধর্মালোচনা, এবং বড় করে হোম করতেন।
ভারত সেবাশ্রমে হোম দেখার মতো । বাঁকুড়া জেলার ভারত সেবাশ্রমের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমার এরকম হোম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাঁকুড়া শহরের কেন্দুয়াডিহির আশ্রমে এই অনুষ্ঠানটি হয় দোল পূর্ণিমার আগের একাদশীতে।
আসামের সেই অনুষ্ঠানে স্থানীয় কুমারী মেয়েরা অংশগ্রহণ করত। তারা লাল পাড়, সাদা শাড়ি পড়ে একহাতে থালা, থালাতে মোমবাতি, আর এক হাতে শঙ্খ নিয়ে মেয়েরা যজ্ঞকুণ্ড পদক্ষিণ করত। এইসব আচার, অনুষ্ঠান, ধর্মসভা অপর্ণাদেবীর মনে রেখাপাত করে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতি সেই ছোটো বয়সেই তাঁর অনুরাগ জন্মায়।
সেই সময় একবার গৌহাটিতে আসেন আত্মানন্দ স্বামী। আত্মানন্দ স্বামী হলেন, গুরুমহারাজ স্বামী প্রণবানন্দের সরাসরি শিষ্য। ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ হলে স্বামী প্রণবানন্দ। স্বামী প্রণবানন্দকে ভারত সেবাশ্রমের সমস্ত অনুগামীরা গুরু মহারাজ বলেন।
স্বামী প্রণবানন্দের জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৮৯৬, অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমার বাজিতপুর গ্রামে। জন্মের সময় তিনি কাঁদেননি। ছোটো থেকে আহারে অনাশক্তি, বহির্জগতের সমস্ত বিষয়ে উদাসীন। বিপ্লবী আন্দোলনের সময় জেল বন্দীও হয়েছিলেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে মাঘী পূর্ণিমার দিন ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন।
বাঙালি তথা হিন্দুজাতি প্রণবানন্দকে মনে রাখবে তাঁর তীর্থ সংস্কারের জন্য। তিনি ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিহারের ‘গয়া’ থেকে তীর্থ সংস্কার শুরু করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ৮ জানুয়ারির কলকাতার বালিগঞ্জ আশ্রমে মহাপরিনির্বান লাভ করেন। তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয় জন্মভূমি বাজিতপুরে। তিনি মাত্র ৪৪ বৎসর ১১ মাস ৯ দিন মানুষ্য দেহে অবস্থান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তাঁর নামে অন্য কোনও মন্দির যেন না করা হয়।
স্বামী প্রণবানন্দ ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াগ কুম্ভমেলায় এসেছিলেন। সেবছর ছিল অর্ধকুম্ভ। সেবার তিনি শ্রীমৎ স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরিজীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম হয় আচার্য শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজ। তার আগে নাম ছিল বিনোদ। সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মাঘী পূর্ণিমার দিন নিজ জন্মভূমি বাজিতপুর ধামে তিনি সংঘের প্রথম ও প্রধান সাতজন ব্রহ্মচারীকে সন্ন্যাস দান করেন।
সেই সাতজন ব্রহ্মচারী ভক্ত মণ্ডলীতে সপ্তর্ষি বলে পরিচিত। সাতজন প্রথম ও প্রধান শিষ্য হলেন – শ্রীমৎ স্বামী সচ্চিদানন্দজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী বেদানন্দজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী যোগানন্দজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দজী মহারাজ, শ্রীমৎ স্বামী আত্মানন্দজী মহারাজ ও শ্রীমৎ স্বামী নির্গুণানন্দজী মহারাজ।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারে পূর্ণকুম্ভ মেলায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রথম সেবা ও প্রচার কার্য শুরু করে। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াগ পূূর্ণকুম্ভেও সংঘ সেবা ও প্রচার কার্য চালায়। কিন্তু সেই পূূর্ণকুম্ভে প্রণবানন্দজী মহারাজ শারীরিক অসুস্থতার কারণ অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই বছরই এলাহাবাদে একটি বাড়ি ভাড়া করে প্রয়াগ ধামে সেবাশ্রম সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তুলারাম বাগে জমি কিনে স্থায়ী আশ্রম গড়ে ওঠে।
সে বছর হয়েছিল অর্ধ কুম্ভমেলা। সেই মেলায় প্রণবানন্দ মহারাজ ১৩ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি অবস্থান করেছিলেন। সেই মেলার বিবরণ হরিপদ বারিকের লেখা ‘প্রয়াগ কুম্ভে শ্রীগুরু দর্শন’ রচনায় পাওয়া যায়। এই রচনাটি স্বামী নির্মলানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত “শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ – শত রূপে, শত মুখে’ গ্রন্থে আছে। হরিপদ বারিক নাগপুর নিবাসী ছিলেন। একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সরকারি চাকুরিজীবী ভক্ত।
[ক্রমশ]
তথ্য ঋণ:
১. শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ চরিতামৃত—স্বামী অরুণানন্দ (ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, ২০১৯)।
২. শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ – শত রূপে, শত মুখে (প্রথম খণ্ড)— স্বামী নির্মলানন্দ (ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, ১৪২৭)