হোলিকা থেকে হোলি!

অভ্রনিলয় বসু

কিরে সৃষ্টি এবার রং খেলবি না? স্কুল তো এবার চার দিন ছুটি৷ অনেক মজা হবে৷ ঋদ্ধিমার কথা শুনে বলল, সে খেলব কিন্ত্ত জানিস সেদিন খবরে শুনছিলাম, এখন যে সব কেমিক্যাল ব্যবহার করে, এতে স্কিনে অনেক ক্ষতি হয়৷ আর তাছাড়া দেখিসনি, কতজন তো এমন রং লাগায় যেটা উঠতেই চায়না৷ সেটা নিয়ে স্কুলে এলে আবার বকুনি খেতে হয়৷ ঋদ্ধিমা বলল, ঠিক বলেছিস, তবে আমরা তো আবির দিয়ে খেলব৷ এছাড়া সেদিন ইন্টারনেটে পড়ছিলাম হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে, এ সময় আগুন জ্বালালে পরিবেশে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়৷ তাই হোলিকা দহন উপলক্ষে আমাদের চারপাশের পরিবেশ পবিত্র হয়৷ সৃষ্টি বলল হোলি খেলাতে আবার আগুন কেন জ্বালাবি ? হোলিকা দহন কি ? ঋদ্ধিমার বলল, আমার বাসস্টপ এসে গেছে রে৷ কাল তো শনিবার আমাদের বাডি় আসিস, সামনেই তো ইউনিট টেস্ট, আমরা গ্রুপ স্টাডিও করব, তারপর আমি দাদাইকে বলব তোকে পুরো গল্পটা বলতে৷ সৃষ্টি বলল, শুনতে হবে তো৷ বেশ ইন্টারেস্টিং!

ঋদ্ধিমা ও সৃষ্টি ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড৷ ওরা ক্লাস সিক্সে পডে়৷ দুজনেই পড়াশুনোতে ভালো৷ ওরা একই টিউশন পডে়, আর্ট শেখে৷ ঋদ্ধিমার বাডি় সৃষ্টিদের বাডি়র দুটো গলি আগে৷ ঋদ্ধিমা নেমে যেতেই সৃষ্টি ভাবতে লাগল, ঋদ্ধিমা কত লাকী, কত মজার মজার গল্প শুনতে পারে ওর দাদাইয়ের থেকে৷ বাবা বাডি় ফিরলে বলব, দাদাইকে এবার নিয়ে আসতে আমাদের বাডি়তে৷


সৃষ্টিও বাডি় ফিরে রোজকার মতো খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়ল৷ সৃষ্টির বাবা পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট৷ তাই বাডি় ফিরতে রাত নয়টা হয়েই যায়৷ মাও অফিসে যায়৷ বাডি় ফিরে টায়ার্ড থাকে৷ তাই সৃষ্টি যখন রাতে পডে় তখন ওর মা পাশে একটু শুয়ে রেস্ট নেয়৷ সৃষ্টি আজ তাড়াতাডি় পডে় নিল৷ বাবা ফিরতেই সৃষ্টি বলল, বাবা আমরা এবার দাদাইকে আমাদের এখানে নিয়ে আসব৷ সৃষ্টির বাবা হেসে বলল, হটাৎ কি হল রে, দাদাইয়ের খোঁজ করছিস ? সৃষ্টি বলল, আমাকে কেউ গল্প শোনায় না বাডি়তে৷ তোমরাও বিজি থাক৷ অথচ ঋদ্ধিমার দাদাই কতো সুন্দর গল্প শোনায়৷ সৃষ্টির বাবা বলল, তোর দাদাইকে তো আমি সব সময়ই বলি, ওখানে তো হরি কাকা রয়েছে, তুমি আমাদের সাথে এসে থাকো৷ আমরা না হয় মাসে একবার করে গিয়ে দেখে আসব৷ কিন্ত্ত বাবার তো এক কথা, তোর ঠাকুরদার ভিটে ছেডে় আমি কোথাও যাবনা৷ অথচ এই কথা অনেকই বোঝেনা, ভাবে আমি বাবা মাকে দেখিনা৷ অবহেলা করি৷ সে যাই হোক, এবার আমি তোকে এই দায়িত্ব দিচ্ছি, এবার দাদাই আর আম্মাকে আনার দায়িত্ব তোর৷ সৃষ্টি মনে মনে বলল, ঠিক আছে, আমরা এবার হোলির ছুটিতেই আনবো দাদাই আর আম্মাকে আমাদের বাডি়তে৷ মুখে কোন কথা বলল না৷ সৃষ্টির মা ওর বাবাকে চা দিয়ে হেসে বলল, ভালোই হবে৷ মা বাবা এলে আমিও তোমার নালিশ করতে পারব৷
পরের দিন সকালে সৃষ্টি তাড়াতাডি় পডে়, স্নান সেরে খেয়ে নিল৷ তারপর বিকেলে গেল ঋদ্ধিমাদের বাডি়৷

আজ শুনতে হবে হোলি দহনের গল্প৷ দরজা খুলতেই ঋদ্ধিমা বলল, তুই এসে গেছিস৷ আমিও মাত্রই খেয়ে উঠলাম৷ ঋদ্ধিমার দাদাই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে হেসে বলল, কিরে সৃষ্টি এক্সামের প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে? পরে খারাপ রেজাল্ট হলে কিন্ত্ত আমি বকুনি খাবো৷ সৃষ্টি বলল, ভালো হচ্ছে দাদাই৷ তুমি চিন্তা করো না৷ আর একটা খুশির খবরও আছে৷ ঋদ্ধিমা বলল, কি রে? সৃষ্টি বলল, আগে গল্পটা শুনেনি তারপর বলব৷ ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, বেশ৷ শোন তবে, ভাগবত পুরাণ এর সপ্তম অধ্যায় অনুসারে, অসুর রাজা হিরণ্যকশিপু অমর হতে চান৷ ঋদ্ধিমা বলল হিরণ্যকশিপু হল ভক্ত প্রহ্লাদের বাবা৷ ঋদ্ধিমার দাদাই বলল হ্যাঁ, তারপর শোন এজন্য তিনি ব্রহ্মার ধ্যানে বসেন৷ কিন্ত্ত দেবতারা খুব কমই অমরত্ব দান করে৷ কিন্ত্ত হিরণ্যকশিপু এমন বর চান যাতে তাঁর মনে হয় যেন পরোক্ষভাবে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন৷ সৃষ্টি বলল, পরোক্ষভাবে মানে? ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, মানে ইন্ডিরেক্টলি৷ সৃষ্টি বলল তা কি ভাবে চাইল? ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, তিনি চাইলেন, তাকে মানুষ যেন হত্যা করতে না পারে, কোন প্রাণীও যেন হত্যা করতে না পারে, তাকে ঘরেও হত্যা করা যাবে না, আবার বাইরেও হত্যা করা যাবে না, তাকে দিনেও হত্যা করা যাবে না আবার রাতেও হত্যা করা যাবে না; তাকে অস্ত্রের দ্বারাও হত্যা করা যাবে না আবার শস্ত্রের দ্বারাও হত্যা করা যাবে না৷ তাকে স্থল, জল বা বায়ু কোথাও হত্যা করা যাবে না৷ সৃষ্টি বলল, ব্রহ্মা দিলেন এমন বর ? ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, হ্যাঁ৷ এই বর লাভ করে হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠে৷ তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেবল তাকেই দেবতা হিসেবে পূজা করা হবে৷ কেউ তার আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন বা হত্যা করবেন৷ তার পুত্র প্রহ্লাদ তার সাথে সম্মত হল না৷ তিনি একজন বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, তার বাবাকে দেবতা হিসেবে পূজা করতে রাজি হল না৷ প্রহ্লাদ বিষ্ণুকেই পূজা করা চালিয়ে গেল৷

এতে হিরণ্যকশিপু খুব রেগে গেল এবং প্রহ্লাদকে হত্যা করার বিভিন্ন চেষ্টা করেন৷ এগুলোর মধ্যে একবার হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য চান৷ সৃষ্টি বলল, তার মানে হোলিকা আসলে প্রহ্লাদের পিসি? ঋদ্ধিমা বলল, হ্যাঁ৷ ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে হোলিকার কোলে বসতে বলেন৷ বসলে তিনি প্রহ্লাদের উপর আগুন জ্বালিয়ে দেবেন৷ এতে প্রহ্লাদ আগুনে পুডে় মারা যাবে কিন্ত্ত হোলিকার কাছে থাকা বিশেষ বস্ত্রের জন্য তার কোন ক্ষতি হবে না৷ কিন্ত্ত সেই আগুন জ্বলতেই হোলিকার শরীর থেকে সেই বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীররে জডি়য়ে গেল৷ এতে হোলিকা আগুনে পুডে় যায়, আর প্রহ্লাদ ক্ষতি থেকে বেঁচে গেল৷

বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার রূপে গোধূলি লগ্নে মানে দিন ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হন৷ সৃষ্টি বলল, নৃসিংহ মানে? ঋদ্ধিমা বলল, মনে কর মুখটা সিংহের এবং শরীর মানুষের৷ ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, হিরণ্যকশিপুকে না বাইরে না ঘরে নিয়ে যান, তাকে নিজের কোলে, যেমন কথা ছিল না বায়ুতে, না স্থলে স্থাপন করেন, ও এরপর হিরণ্যকশিপুর নাডি়ভুডি় বের করে ও তার থাবা দিয়ে, না অস্ত্র না সস্ত্র তাকে হত্যা করেন৷ এভাবে হিরণ্যকশিপুর লাভ করা বর তাকে বাঁচাতে পারেনি৷ প্রহ্লাদ ও মানব জাতি বাধ্যবাধকতা ও ভয় থেকে মুক্তি পায়৷ নৃসিংহের দ্বারা হিরণ্যকশিপু বধ এর এই কাহিনী অশুভ এর উপর শুভের জয়কে নির্দেশ করে৷ হোলিকা দহন বা নেড়াপোড়া উৎসব এই ঘটনাটিকেই নির্দেশ করে৷ হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয়৷ তারপর সব পবিত্র হয়ে রাধা কৃষ্ণ হোলি খেলেন৷
সৃষ্টি বলল, এবার বুঝলাম হোলি নামটা তাহলে কথা থেকে এসেছে৷ ঋদ্ধিমা বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই৷ এবার তোর খুশির খবরটা শুনি৷ সৃষ্টি বলল, আমরা এই হোলির ছুটিতে গ্রামের বাডি় যাব দাদাই আর আম্মাকে নিয়ে আসতে৷ কাল রাতে পড়ার পর ফোন করে প্রমিস করিয়েছি৷ ঋদ্ধিমা বলল, তাহলে তো আরো মজা হবে৷ আরো বেশি গল্প শুনতে পারব৷ ঋদ্ধিমার দাদাই বলল, আমিও এক বন্ধু পাবো আর তখন তোরা জানতে পারবি, কি ভাবে হোলি খেলত রাধা কৃষ্ণ৷ কেনই বা আভা রঙ ঠাকুরের পায়ে আগে দিতে হয়! ঋদ্ধিমা এবং সৃষ্টি এক সাথে বলে উঠল, ঠিক বলেছ, এই দাদাইয়ের প্রথম গল্পই হবে এটা৷ এখন চল পড়তে বসি, বলেই ওরা ভেতরের ঘরে গেল৷ ঋদ্ধিমার দাদাইও বিকেলে হাঁটতে বেরোল৷