বাংলা উপন্যাসে নদীজীবনের বহুমুখী পাঠ

কাঁটাতারের বিভাজনকে সরিয়ে দুই বাংলার সাহিত্যকে একত্রিত করলে দেখা যায় বাংলার সাহিত্যভাণ্ডারে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর। নদীকেন্দ্রিক রোমান্টিসিজম কোনও দেশকালের সীমারেখা মানে না। নদীনির্ভর জীবিকা অর্জনকারীরা প্রায়শই জীবিকার প্রয়োজনে সমুদ্র যাত্রা করেন। সমুদ্রের বুকে ভাসমান জেলে-নাবিকদের সঙ্গে নদীনির্ভর জেলে-মাঝিদের জীবন-জীবিকার সাদৃশ্য চোখে পড়ে বারবার। তাই বাংলা সাহিত্য পাঠকদের কাছে জলজীবন সর্বোপরি জলজীবীদের কথা বরাবরই আকর্ষণের বিষয়।

নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ শুরু হয়েছিল বহু প্রাচীনকাল থেকেই। আর সেই থেকেই শুরু নদীর সঙ্গে জীবনের তুলনা। নদীর গতি সর্বদাই আমাদের অনুপ্রাণিত করে। নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস লেখার প্রয়াস বহু ঔপন্যাসিকই করেছেন। নদী, নদীকেন্দ্রিক জীবিকা, মাঝি-মাল্লা তাদের পরিবার ও সমাজ এবং বিকল্প আয়ের নানা অনুসন্ধানের চিত্র এইসব রচনায় যেমন আছে তেমনি অন্ত্যজ সমাজের নানা সংঘাত কিম্বা শ্রমজীবী মানুষের দ্বন্দ্ব সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র চিত্র স্থান পেয়েছে এইসব রচনায়। নদীর গতি পরিবর্তনের সঙ্গে জীবনের নানা পরিবর্তনকে ঔপন্যাসিকগণ দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। সমুদ্রকেন্দ্রিক বিখ্যাত উপন্যাস Ernest Hemingway-এর The Old Man and the Sea’-এর মতোই গঙ্গা, পদ্মা, তিতাস, কোপাই, তিস্তা প্রবহমান হয়ে জীবনকে প্রতিফলিত করেছেন রচনাকারদের জীবন দশর্নের তারতম্যে। এই সমস্ত নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস নিয়ে চমৎকারভাবে সূত্রে গেঁথেছেন ড. সুমনা পাত্র তাঁর নতুন ‘বাংলা উপন্যাস: নদীজীবনের বহুমুখী পাঠ’ গ্রন্থ’টিতে।

লেখিকা তাঁর আত্মকথনে লিখছেন, “নদী আমার আজন্মের এক ভালোবাসার বিষয়। রুক্ষ-শুষ্ক পুরুলিয়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবাদে জলকষ্টের সঙ্গে আমার জন্মাবধি পরিচয়। আমাদের আদরের কাঁসাই নদীতে শুধুমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া আর কখনও জল থাকতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সেই নদীতেও এক সময় ভয়াল বন্যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমি খুবই ছোটো, তাই সাল-তারিখ ঠিক মতো মনে নেই। তবে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস বা নদীতীরবর্তী জীবন নিয়ে প্রথম ভাবনা জন্মায় কলেজে পড়ার সময়… এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে হাতে পাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসটি। ক্রমশ নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস পাঠের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।”


এই আগ্রহই নতুন মাত্রা দিয়েছে গ্রন্থটিতে। দুই বাংলার নদীসাহিত্য নিয়ে এত ভিন্ন স্বাদের আলোচনা চালিয়েছেন তিনি। যেখানে নদীনির্ভর মানুষদের জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি, তাদের ভাষাশৈলীর আরও বিচিত্র পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে। বিখ্যাত রচনাকারগণের পাশাপাশি অনামী ঔপন্যাসিকদের রচনাকেও বিশ্লেষণ করেছেন গুরুত্ব সহকারে। নবীন ও প্রবীন রচনাকারদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন গ্রন্থে।

আসলে নদীমাতৃক দুই বাংলার মানুষের একটা বড় অংশ নদীর বুকে ভেসে বেড়ায়। কেউ মাছ ধরে, কেউ মাঝি বা দাঁড়ির কাজ করে, আবার কেউ বা উর্বর নদীচরে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই কেবলমাত্র আঞ্চলিক উপন্যাসের একটি বিশেষ ধারা হিসেবে নয়, বৃত্তিজীবী শ্রেণির জীবনকথা হিসেবেই দুই বাংলার নদীকেন্দ্রিক বাংলা উপন্যাসের আলোচনা করেছেন লেখিকা।

তাই তো বলাই যায়, গ্রন্থটি সাধারণ পাঠক, নদী গবেষক ও ছাত্র-ছাত্রী সকলের হৃদয় জয় করবে এবং বাংলা সাহিত্যে একটি উজ্জ্বল মাইল ফলক হয়ে থাকবে। আসলে, দুই বাংলার নির্বাচিত নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস নিয়ে যে কাজ লেখিকা করেছেন, বাংলার ভূসাংস্কৃতিক চরিত্রের পক্ষে তা অনিবার্য ছিল। এই একই বিষয়ে আরও আলোচনা নিশ্চয়ই হয়েছে, হবার সুযোগও আছে। কিন্তু এ গ্রন্থটির পরিসর দুই বাংলা হওয়াতে এতে একটি তুলনার উপাদানও এসেছে, কারণ দুই বাংলার নদীগুলির চরিত্র সর্বাংশে এক না হওয়ারই সম্ভাবনা, সামাজিক চরিত্রেও ভিন্নতা আছে।

গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির আর একটি ভাললাগার বিষয় এর প্রচ্ছদ এবং মুদ্রণ। এক্ষেত্রে কমলিনী প্রকাশনীর কর্ণধার শুভঙ্কর (অপু) দে’র অবদান অস্বীকার করা যায় না। দে’জ থেকে প্রাপ্ত বইটির দাম ৬০০ টাকা।