বেঁচে উঠছে হিন্দমোটর, তৈরি হবে ১২৮ চাকার অত্যাধুনিক কোচ

দীর্ঘ এক দশকের নীরবতার পর অবশেষে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে হুগলির ঐতিহাসিক হিন্দমোটর। এক সময়ের আইকনিক অ্যাম্বাসাডর গাড়ির আঁতুরঘরে এবার নতুন করে শুরু করতে চলেছে শিল্পের পথচলা – তাও আর চার বা ছয় চাকার গাড়ি নয়, একেবারে ১২৮ চাকার আধুনিক রেল কোচ। হিন্দমোটরের জমিতে তৈরি হতে চলেছে রেলের কোচ নির্মাণের একটি বৃহৎ কারখানা, যেখানে নির্মিত হবে মেট্রো রেল ও বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের বিলাসবহুল কোচ।

২০১৪ সালে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় হিন্দুস্তান মোটরসের কারখানা। ঝোলানো হয় ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’-এর নোটিশ। প্রায় ৩৯৫ একর জমি পড়ে ছিল অব্যবহৃত অবস্থায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমে ওঠে হতাশা, দগদগে হয়ে ওঠে স্মৃতির ক্ষত। কিন্তু এবার সেই জমিতে গড়ে উঠতে চলেছে নতুন শিল্প পরিকাঠামো।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রায় ৪০ একর জমি ৯৯ বছরের লিজে তুলে দেওয়া হয়েছে টিটাগড় রেল সিস্টেম লিমিটেড (টিটাগড় ওয়াগন)-এর হাতে। প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে উঠবে এই আধুনিক কোচ নির্মাণ কারখানা। ইতিমধ্যে সংস্থাটি প্রায় ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বরাত পেয়েছে মেট্রো রেল ও ইএমইউ ট্রেনের এসি কোচ তৈরির জন্য।


এই শিল্প স্থাপনের পথে বড় বাধা ছিল জমির অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিতর্ক। ২০২২ সালে রাজ্য সরকার হিন্দমোটরের জমি অধিগ্রহণ করে, যা চ্যালেঞ্জ জানায় হিন্দুস্তান মোটরস। কলকাতা হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যের পক্ষে রায় দিলে সেই জটের অবসান ঘটে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিভি নাগারত্না ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, রাজ্যের সিদ্ধান্ত আইনসিদ্ধ। প্রসঙ্গত, ওয়েস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট অনুযায়ী, শিল্প গড়ার উদ্দেশ্যে নেওয়া জমি দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হলে তা অধিগ্রহণের অধিকার সরকারেরই থাকে।

এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে তুমুল আলোড়ন। তৃণমূলের দাবি, এই শিল্পায়নের কৃতিত্ব তাদের সরকারেরই। হুগলি জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য – রেলের কোচ নির্মাণ কেন্দ্র করে বহু আনুষঙ্গিক ছোট শিল্প গড়ে উঠবে, কাজের সুযোগ পাবে এলাকার বহু মানুষ। হুগলি শ্রীরামপুর জেলা তৃণমূল সহ সভাপতি স্বপন দাস বলেন, ‘এখানে রেলের কোচ ফ্যাক্টরি হবে তার সঙ্গে বহু আনুষঙ্গিক আরও ছোট ছোট ফ্যাক্টরি হবে, যেখানে মানুষ কাজ পাবে। শিল্পের জমিতে শিল্প হলে, শিল্পপতিদের কাছেও একটা ভাল বার্তা যাবে।’

অন্যদিকে, বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলো এখনই এই ঘোষণার উপর ভরসা করতে পারছে না। বাম নেতাদের বক্তব্য, অতীতের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, তাই এবারও আশ্বাসে ভরসা রাখা কঠিন। প্রাক্তন শ্রমিকদের অনেকের প্রাপ্য টাকা এখনও বাকি, তাঁদের পুনর্নিযুক্তির দাবি তুলে তাঁরা বলছেন – শুধু নতুন শিল্প নয়, পুরনো শ্রমিকদের পাওনাও মিটিয়ে দেওয়া হোক। হিন্দুস্তান মোটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তথা সিটুর হুগলি জেলা সভাপতি মলয় সরকার জানান, এত কিছু হলেও তাঁরা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।

রাজ্যের উদ্যোগ ও কেন্দ্রের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারের আবহে এই কারখানা ভবিষ্যতের দিকদর্শন হতে পারে বলে মত শিল্প মহলের। মেট্রো রেল ও বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের মতো প্রকল্পের অংশীদার হতে পারা শুধু হুগলি নয়, গোটা বাংলার জন্যই বড় সম্মান। ‘হিন্দমোটরের নবজাগরণ’ একদিকে যেমন শিল্প সম্ভাবনার বার্তা দিচ্ছে, তেমনই দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে গোটা রাজ্যকে। সময় বলবে, এ স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হয়। তবে এতদিন পরে শিল্পসম্ভাবনার কথা শুনে আশায় বুক বাঁধছে হুগলির মানুষ।