এবার ঘরে বসে নোনা জলের মাছের স্বাদ পাবেন। ড্রোনের মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাজা মাছ নিমেষে পৌঁছে যাবে শহরে। ২৯তম সুন্দরবন কৃষ্টি মেলা ও লোকসংস্কৃতির উৎসবে এই বছর নজর কাড়ল এই অনন্য উদ্যোগ — কার্গো ড্রোনের মাধ্যমে মাছ পরিবহনের প্রদর্শনী। সুন্দরবন মহিলা মৎস্য চাষি দিবসে অনুষ্ঠিত এই উদ্ভাবনী প্রদর্শনী ভবিষ্যতে মাছ বিপণন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই মেলায় সুন্দরবনের বিভিন্ন ব্লক থেকে প্রায় পাঁচ হাজার মহিলা মৎস্য চাষী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের উপ-মহানির্দেশক ফিশারি সায়েন্স বিভাগের ড. জয়কৃষ্ণ জেনা। উপস্থিত ছিলেন আইসিএআর সিফ্রির অধিকর্তা ড. বসন্ত কুমার দাস এবং জাতীয় মৎস্য উন্নয়ন পর্ষদের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ আর. অরুণ কুমার। মেলা কমিটির চেয়ারম্যান লোকমান মোল্লা পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। এদিন পাঁচজন সফল মহিলা মৎস্য চাষীকে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা জানানো হয়।
লোকমান মোল্লা বলেন, ‘সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক মহিলা আজ জীবিকার পথে মৎস্যচাষের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের হাতে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দিলে সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’ সুন্দরবন এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ সীমিত। একবার মাত্র ধান চাষ করা হলেও প্রতিবছর বন্যা, খরা এবং অতিবর্ষণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিবারের পুরুষরা জীবন জীবিকার তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার কারণে মহিলারা মাছ চাষে এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের সেই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে সুন্দরবনের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো এবং সার্বিক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।
ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ড. জয়কৃষ্ণ জেনা আশ্বাস দেন, আগামী দিনে সুন্দরবনের মহিলা মৎস্য চাষীদের পাশে কেন্দ্রীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের বিভিন্ন সংস্থা আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করবে।
এই দিনের মূল আকর্ষণ ছিল কার্গো ড্রোনের সফল উড়ান ও মাছ পরিবহনের প্রদর্শনী। ড. বসন্ত কুমার দাস জানান, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দ্রুত শহরের বাজারে মাছ পৌঁছে দেওয়াই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। পরীক্ষামূলক উড়ানে প্রায় ৭০ কিলোগ্রাম মাছ বোঝাই ড্রোন তিন কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তা পুনরায় নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে আসে। উপস্থিত মৎস্য চাষীরা এই প্রদর্শনী দেখে উৎসাহিত ও কৌতূহলী হন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুন্দরবনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, জোয়ার–ভাটা নির্ভর জলপথ এবং সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মাছ দ্রুত বাজারে পৌঁছনো কঠিন। ড্রোন প্রযুক্তি চালু হলে অল্প সময়ে এবং কম খরচে নষ্ট না করেই মাছ শহরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এতে চাষিরা ন্যায্য দাম পাবেন, ক্রেতারাও টাটকা মাছ খেতে পারবেন।
এই মেলায় স্থানীয় মহিলা মৎস্য চাষীরাও তাঁদের আশার কথা জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এই প্রযুক্তি গ্রাম থেকে বাজার পর্যন্ত নিয়মিত ব্যবহৃত হলে পরিবহন খরচ কমবে, সময় বাঁচবে এবং আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে বর্ষাকাল ও দুর্গম এলাকায় যেখানে যাতায়াত বড় সমস্যা, সেখানে ড্রোন বড় সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। ফলে কৃষ্টি মেলার এই প্রদর্শনী শুধু প্রযুক্তিগত অভিনবত্ব নয়, সুন্দরবনের নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথেও নতুন আশার আলো।